চোখের জলে - চৌরা | chokherjole.blogspot.com

অনেক অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন প্রথম মা হতে চলেছি। কিছু সমস্যার কারণে আমাকে প্রতি মাসে একবার ঢাকায় আসতে হতো ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য।

চোখের জলে - চৌরা | chokherjole.blogspot.com

চোখের জলে - চৌরা  chokherjole.blogspot.com
চোখের জলে - চৌরা  chokherjole.blogspot.com

যখন সাত মাস চলছে তখন ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে যাচ্ছি কর্তার কর্মস্থলে। পদ্মার ফেরি পার হয়ে কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ বাসের চাকা পাংচার হয়ে গেল। চাকা খুলে নতুন চাকা লাগাতে বেশ একটু সময় লাগবে।বাসের যাত্রীরা সবাই বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারে গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালো।

আমিও বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারের বাড়িগুলো দেখিয়ে কর্তাকে বললাম --আমি একটু ওদিক থেকে ঘুরে আসি?

উনি বললেন- যাও, তবে নতুন জায়গা, সাবধান যেও।

আমি ধীর পায়ে গিয়ে হাজির হলাম একটা বাড়িতে। শুকনো কলাপাতার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি কয়েকজন মহিলা বাড়ির উঠানে তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউ রান্নার যোগাড় করছে, কেউ ভেজা কাপড় রোদে দিচ্ছে। একজনকে দেখলাম ঘরের দাওয়ায় বসে শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে। এই বাড়িতে এমনকি আশপাশে কোথাও কোনো পুরুষ মানুষ চোখে পড়লো না।

 বয়স্ক মানুষ যিনি কাপড় রোদে দিচ্ছিলেন আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন।হাসি মুখে বললেন বুঝতে পারছি, আহেন। তিনি আমাকে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন।

আমি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম --আপনি বুঝলেন কিভাবে?

তিনি হেসে বললেন - বোঝোন যায়, জিগাইতে হয় না। শব্দ শুইনা বুঝছিলাম গাড়ীর চাকা নষ্ট হইছে। আপনি বহেন। চাকা লাগাইতে সময় লাগবো।

মহিলা আমার জন্য ঘরের দাওয়ায় একটা পাটি বিছিয়ে দিলেন। আমি গিয়ে পাটিতে বসতে বসতে বললাম -বাস না আবার ছেড়ে দেয়। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন -চিন্তা কইরেন না। আমার নাতিরে পাঠাইতেছি। হইয়া গেলে ডাকবোনে।

যে মহিলা রান্নার কাজে ব্যস্ত তাকে বললেন -বৌ,কুটুমরে এক মগ পানি দেও। তিনি নিজে উঠোনের গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে আমার হাতে দিলেন। খুব লজ্জা করছিল কিন্তু তার আন্তরিকতা দেখে পেয়ারা নিতে হলো।

তিনি জানতে চাইলেন কোথায় যাচ্ছি, বাপের বাড়ি না শ্বশুর বাড়ি?আমি নিজের বাড়িতে যাচ্ছি শুনে জানতে চাইলেন -স্বামী কি কাম করে?

আমার স্বামী সরকারি চাকরিতে আছেন শুনে খুব খুশি হয়ে জানালেন-ঐ পূব পাড়ার মতি সরদারের বড় পোলাও সরকারি চাকুরিতে আছে। হ্যায় পুলিশের দারোগা, খুব দাপট। বাড়িতে আইলে সক্কলে তারে খুব মান্যি করে।

যে কিশোরী মেয়েটা ঘরের দাওয়ায় বসে শিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছে তার দিকে নজর গেল। মেয়েটি এরই মধ্যে মা হয়ে গেছে। দেখলেই কষ্ট লাগে। বয়ষ্ক মহিলার কাছে মেয়েটা কে জানতে চাইলে বললেন -হেয় আমার নাতনি। বড় পোলার মাইয়া। বাচ্চা হইতে আইছে। মাইয়া হইছে একমাস হইলো।

শ্বশুর -শাশুড়ি পোলা হয় নাই দেইখা গোসা করছে, তয় নাতজামাইটা বড় ভালা, মাইয়ারে বড়ই যত্ন করে।

 নাতজামাই কি করে জানতে চাইলে বললেন -হ্যায় তো 'চৌরা'। আমার স্বামী, তিন পোলা হগগলেই 'চৌরা'।

আমার জন্ম, বেড়ে উঠা সবকিছুই শহরে। 'চৌরা' শব্দের সাথে কখনো পরিচয় ঘটেনি।

তাই একটু অবাক হয়ে বলি-'চৌরা'!

উনি বুঝতে পেরে নিজেই জানালেন --আমাগো বাড়ির বেডারা হগগলেই চরে  কাম করে। চরে যারা কামে যায় তাগোরে 'চৌরা' বলে।

ঠিক সেই সময় নাতি এসে জানান দিল বাসের চাকা লাগানো শেষ।

আমি তাড়াতাড়ি করে দাওয়া থেকে নামার চেষ্টা করছি দেখে উনি বললেন -সবুর সবুর, এই সময়ে খুব সাবধানে উঠাবসা কইরতে হয় গো মা জননী। দেইখে তো মনে অয় সাত-আট মাস, মনে কয়"মাইয়া হইবো।"

আমার নাতনিরেও তাই কইছিলাম। হ্যায় অহন মোরে গাল পাড়ে মাইয়া হইছে দেইখা।হ্যায় তো বুঝেনা পরথম সন্তান মাইয়া হওন মেলা ভাগ্যের কথা।

তিনি আমাকে নিজে এসে বাসে তুলে দিলেন।

কর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে বললেন - একটু দেইখা রাইখেন, পরথম পোয়াতি। আমার চোখে পানি চলে এলো।

আমার নিজের মা ছাড়া আরেকজন মায়ের সাথে দেখা হলো যিনি পরম মমতায় মেয়েকে বিদায় জানাচ্ছেন।